আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সারা দেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের সহিংস কর্মকাণ্ড, দখলবাজি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, হুমকি ধমকিসহ যে কোনো ধরনের অপকর্ম রোধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে বিএনপি। গত কয়েকদিন ধরে কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীদের কঠোর বার্তা দিচ্ছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে দলটি। সামান্য অপরাধেও ছাড় পাচ্ছে না নেতারা। দেদারচ্ছে চলছে শোকজ ও বহিস্কার একই সঙ্গে কোন ঘটনা ঘটার সাথে সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে নিচ্ছেন ব্যবস্থা। দলের ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন করায় গতকাল ময়মনসিংহে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা পর্যন্ত করা হয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রতিদিন নেতাকর্মীদের উদ্দেশে স্পষ্ট বলছেন, কোনো রকমের সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, সহিংসতা বরদাস্ত করা হবে না। বিএনপিতে কোনো রকমের সন্ত্রাসী বা দুষ্কৃতকারীর ঠাঁই হবে না। বরং কেউ চাঁদাবাজি করলে তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দিতে হবে।
এদিকে বিভিন্ন ঘটনায় জড়িত থাকা ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনগুলো ব্যবস্থা নিচ্ছে। দলের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত কোনো পর্যায়ের নেতাকেই ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। দীর্ঘদিন গুম হয়ে ভারতে নির্বাসিত থেকে সদ্য দেশে প্রত্যাগত দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ এবং কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবীর খোকনকেও শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে কারণ দর্শানো নোটিস পাঠানো হয়েছে। ভালুকা বিএনপির আহ্বায়ক ও কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতা ফখরুদ্দিন বাচ্চুসহ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় তাদেরকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বাদী হয়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলাও করেছেন। ব্যবসা বাণিজ্যের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরিতে বাধা সৃষ্টির অভিযোগে ময়মনসিংহ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ফখরুদ্দিন আহমেদ বাচ্চুসহ অজ্ঞাতনামা ১৫/২০ জনকে আসামি করে মামলাটি করা হয়েছে।
জানা গেছে, দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে ধারাবাহিক বিভাগীয় মতবিনিময় সভাগুলোয় প্রধান অতিথির (ভার্চুয়াল) বক্তৃতায় একই বার্তা দিয়ে যাচ্ছেন বিএনপির হাইকমান্ড তারেক রহমান। তিনি পরিষ্কার ভাষায় বলছেন, বিএনপিতে কোনো দুষ্কৃতকারীর ঠাঁই হবে না। জনগণের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হবে। ইনসাফ আর ভালোবাসা দিয়ে মানুষের মন জয় করার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির এই শীর্ষ নেতা। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দেশের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাওয়ারও নির্দেশনা দিয়ে তারেক রহমান বলেছেন, দলের নাম ভাঙিয়ে কিছু দুষ্কৃতকারী দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টায় লিপ্ত। এদের সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দিতে হবে। তার এসব নির্দেশনা ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন শুরু করেছেন দলীয় নেতাকর্মীরা। দেশব্যাপী নৈরাজ্য প্রতিরোধ করে জনমনে স্বস্তি ফেরাতে তৎপরতা চালাচ্ছেন তারা। জনগণের বিশ্বাস এবং ভালোবাসা অর্জন করতে কাজ করছেন। ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের পর গত ২৮ দিনে বিএনপি ও এর অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের ২ শতাধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ ছাড়া কারণ দর্শানোর নোটিস (শোকজ) ও পদ স্থগিত করা হয়েছে শতাধিক নেতাকর্মীর। এ তালিকায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরাও রয়েছেন। কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। দলের অন্যতম নেতা চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুকে পদাবনত করে উপদেষ্টা থেকে নির্বাহী সদস্য করা হয়েছে। ফরিদপুরের নগরকান্দায় আধিপত্য বিস্তারে সংঘর্ষের ঘটনায় একজন নিহত হওয়ার পর বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ও কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুলের পদ স্থগিত করা হয়েছে। দলের কান্ডারি তারেক রহমানের কড়া নির্দেশ অনুযায়ী শৃঙ্খলা রক্ষায় জিরো টলারেন্স দেখাচ্ছে বিএনপি। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, কেউ বিএনপির নাম ব্যবহার করে কোনো অপকর্ম করতে চাইলে তাকে ধরে আইনের হাতে তুলে দিন। গির্জা, মন্দির, প্যাগোডার নিরাপত্তা দিন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেছেন, ধর্ম, বর্ণ, বিশ্বাস দিয়ে মানুষকে মাপা যাবে না। একজন ব্যক্তির পরিচয় তিনি মানুষ। আপনার পাড়া প্রতিবেশী যেখানেই কেউ এমন কিছু করার চেষ্টা করবে ভুক্তভোগীর বন্ধু হিসেবে তার নিরাপত্তায় আপনি ঢাল হিসেবে দাঁড়িয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বসবাসকারী সবার একটিই পরিচয় আমরা বাংলাদেশি। নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, পরাজিত অপশক্তির পাতা ফাঁদে কেউ পা দেবেন না। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান চূড়ান্ত সফলতায় নিতে হলে কেউ দখলদারিতে লিপ্ত হবেন না, দখলদারিতে সহায়তা করবেন না। কেউ আইন নিজেদের হাতে তুলে নেবেন না।
এদিকে নানা অপকর্মে জড়িতরা বেশির ভাগই ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে দাবি বিএনপি নেতা-কর্মীদের। তাদের মতে, এরা দলের কোনো পদপদবিতে নেই। অতীতে ছিল না দলীয় কোনো কর্মসূচিতে। আন্দোলন সংগ্রামেও দেখা যায়নি। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তারাই এখন বিএনপির ‘নেতাকর্মী’ সেজে গেছে। দাপট দেখাতে শুরু করেছে নিজ নিজ এলাকায়। স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দখল, চাঁদাবাজি আর অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে অনেকে। এ পরিস্থিতিতে ‘অনুপ্রবেশকারী’ কথিত নেতাকর্মীর বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্তও রয়েছে দলের। পাড়ামহল্লায় প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়েছে। রাজধানীসহ কয়েকটি জেলায় দখল করা বাড়ি, দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিএনপি ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতারা দখলমুক্ত করে প্রকৃত মালিককে বুঝিয়ে দিয়েছেন এমন ঘটনাও অনেক রয়েছে। মানিকগঞ্জে বিএনপি নেতারা পরিবহন সেক্টরকে চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসমুক্ত করেছেন। জানা গেছে, গত তিন সপ্তাহে বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের ২ শতাধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে যুবদলের প্রায় ৮০, ছাত্রদলের ২০, বিএনপির ৬০ ও স্বেচ্ছাসেবক দলসহ অন্যান্য সংগঠনের আরও বেশ কয়েকজন নেতা রয়েছেন। এ ছাড়া সাত জেলায় বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়েছে। শাস্তি পাওয়া নেতাদের মধ্যে অধিকাংশই হচ্ছেন ঢাকা মহানগর, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, বগুড়া, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরিশাল, পঞ্চগড়, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নরসিংদী, নোয়াখালী, ঝিনাইদহ, লালমনিরহাট ও লক্ষ্মীপুর জেলার। ছাড় দেওয়া হচ্ছে না কেন্দ্রীয় নেতাদেরও। বিএনপির বরিশাল বিভাগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিনের দলীয় পদ স্থগিত করা হয়েছে। শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবুল হাশিমকে বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদসহ সকল পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। সংগঠনবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগে সোমবার চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান, প্রথম যুগ্ম আহ্বায়ক মো. এনামুল হক এনাম ও আহ্বায়ক কমিটির সদস্য এস এম মামুন মিয়ার প্রাথমিক সদস্যসহ সকল পর্যায়ের পদ স্থগিত করা হয়েছে। রাজধানীর আদাবর থানা বিএনপির একজন যুগ্ম আহ্বায়ক জানান, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাজধানীর মোহাম্মদপুরে আলোচিত-সমালোচিত সাদিক অ্যাগ্রোর জায়গায় বিএনপির সাইনবোর্ড ব্যবহার করে একটি মহল দখলের চেষ্টা করে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নজরে আসার পর তাঁর নির্দেশে তাৎক্ষণিক ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হকের নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা সেখানে গিয়ে খালের জায়গায় গড়ে তোলা রাজনৈতিক কার্যালয়টি দেখে তা ভেঙে ফেলেন। উদ্ধার করেন খালের সরকারি জায়গা। যে কোনো অনিয়মের বিষয়ে দলের অবস্থান প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, দেশের অনিয়ম দূর করতে আন্দোলন করেছি। দলের কেউ যদি কোনো অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকে তা বরদাস্ত করা হবে না। তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, বিএনপিতে কোনো অনিয়ম দুর্নীতি বরদাস্ত করা হবে না। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, বিএনপিতে কোনো দুষ্কৃতকারীর ঠাঁই নেই। তবে বিএনপির নাম ব্যবহার করে পতিত আওয়ামী লীগের কোনো কোনো ব্যক্তি নানা অপকর্ম করার চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ আসছে। সে জন্য দলে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে এরই মধ্যে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।