দুই কিলোমিটারের স্রোতধারায় বহমান মূল নদী শুকিয়ে কোথাও পঞ্চাশ মিটার কোথাও এক’শ মিটার প্রশস্ত মরা খাল। ফাল্গুন মাসেই স্রোত হারিয়েছে তিস্তা নদী, তাতে নৌকা চালানোই দায়। তিস্তার এই ‘প্রায় পানিশূন্যতা’কে কাজে লাগিয়ে সবুজ রঙে সাজিয়েছেন দুই তীরের কৃষকরা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, লালমনিরহাট সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, রাজপুর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত চরে ফসলে ফসলে ছেয়ে গেছে বালুময় তিস্তা নদীর বুক। যেদিকে চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। কোথাও আলু, কুমড়া, লাউ, পেয়াজ, রসুন, সরিষা, মুলা, পালংশাক, ধনে পাতা; কোথাও আবার ধান, ভুট্টা, তামাক, গম, বাদাম চাষ করেছেন শত শত চাষী।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু সদর উপজেলার চর নয়, জেলার পাঁচটি উপজেলার শতাধিক দ্বীপচরে ব্যাপকহারে ফসল আবাদ হয়েছে।
কৃষকরা জানান, বছরে একবার ফসল হয় এসব রূপালী দ্বীপচরের জমিতে। বর্ষায় ডুবে থাকলেও নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত চলে নানা ফসলের চাষাবাদ। একটা সময়ে শুধু আলুর আবাদ হলেও বর্তমানে শীতকালীন সবজি থেকে নানা প্রকারের অর্থকারী ফসল বোনেন তিস্তা অববাহিকার চির সংগ্রামী মানুষগুলো। এতে বন্যা-নদীভাঙনের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা চলে তাঁদের।
সূর্য ওঠার সাথে সাথে শুরু হয় তাঁদের কর্মব্যস্ততা, চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত কখনও কখনও তা রাতেও। বিশেষ করে যেসব জমিতে সেচের প্রয়োজন সেই জমিতে নালা তৈরি, প্রয়োজন ও সময়মত সেচ দেয়া জমির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় কেউ কেউ রাত জেগেও কাজ করেন।
সকাল আটটায় কালিমাটি পাকার মাথা নদীঘাটে গিয়ে দেখা যায়, গবাদিপশু আর কৃষি উপকরণ নিয়ে কৃষকরা ছুটছেন চরের জমিতে। সেখানে কেউ কেউ তারও আগে থেকে কাজে লেগে পড়েছেন। কেউ ব্যস্ত সেচ দিতে, কেউ ব্যস্ত জমি নিড়ানিতে। চারদিকেই ফসলের গাছ। কোনো জমিতে কয়েকদিনের রোপণ করা গাছ; কোনোটায় আবার ফসলের গাছে ঢেকে গেছে চরের বালুময় মাটি।
চিনাতুলি গ্রামের কৃষক দীপক বর্মন জানান, তিনি দুই বিঘা জমিতে আলু, এক বিঘায় ভুট্টা আবাদ করেছেন। প্রথমে জমি তৈরির কাজ করেছেন নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে। বর্তমানে তার আলু তোলার সময় প্রায় হয়ে এসেছে। আর ভুট্টা খেতে চলছে পরিচর্যার কাজ। ঘুম থেকে উঠেই প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আর দুপুরের খাবার সাথে করে নিয়ে নদী পার হয়ে আসেন ফসলের খেতে। সাথে থাকেন স্ত্রী সবিতা রাণী এবং আট বছরের কন্যা শেফালি।
হরিণচড়া গ্রামের কৃষক আজিজ মিয়া জানান, তার বাপদাদার ভিটে তিস্তা গ্রাস করেছিল। বছর চারেক হলো সেটা জেগে উঠেছে। সেখানে তিনি কুমড়া আর গম চাষ করেছেন। কিন্তু নিজের সেচযন্ত্র না থাকায় ভাড়া দিয়ে ফসলি জমির সেচের কাজ চালান। ঘণ্টায় দুইশত টাকা দেন সেচের জন্য।
একই গ্রামের ফজল আলী জানান, আর কয়েকদিন পরেই সরিষা তুলতে পারবেন তিনি। তবে পেয়াজ তুলতে আরও এক মাস লেগে যেতে পারে। সার, বীজ আর কৃষি শ্রমিকের মজুরি বাড়ায় আবাদের খরচ বেড়ে গেছে। ফসলের দাম নিয়ে তাই শংকায় আছেন ফজল আলী। তাঁর মতে, চরের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দামের জন্য সরকারীভাবে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হলে কৃষকরা চরে ফসল উৎপাদনে আগ্রহী হতো। কারন চরে ফসল ফলানো বেশি কষ্ট সাধ্য। উপযুক্ত দাম না পেলে এই শ্রম কৃষকদের বিফলে যাবে, চাষাবাদে আগ্রহ হারাবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) সৈয়দা শিফাত জাহান বলেন, এবারে তিস্তার চরে নয় হাজার হেক্টরের অধিক জমিতে বিভিন্ন ফসল আবাদ হয়েছে। সেই সাথে এসব ফসলের ফলনও তুলনামূলক বেশি আশা করা হচ্ছে।